শহীদ শিক্ষকদের অ্যালামনাই সম্মাননা পদক প্রদান
তারা ছিলেন জাতির দিশারি। মুক্তিকামী জনতাকে নিজেদের মেধা ও মনন দিয়ে গড়ে তুলছিলেন ধাপে ধাপে। সবাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্বদেশি শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও ঐতিহ্য নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন দৃঢ় চিত্তে। এই বিপ্লবী ভূমিকার কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন তারা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের বিভিন্ন সময়ে জাতির এই মেধাবী সন্তানদের হত্যা করে হানাদার বাহিনী। দেশের এমন সাত সূর্যসন্তানকে গতকাল শনিবার সম্মাননা জানিয়েছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। ঢাবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন পদক ২০১৮ প্রদান করা হয় তাদের। সম্মাননাপ্রাপ্ত সাত শহীদ বুদ্ধিজীবী হলেন ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব (জেসি দেব), জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আবু নাসের ম. মনিরউজ্জামান, আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জাল হায়দার চৌধুরী, মোহাম্মদ আনোয়ার পাশা এবং এসএমএ রাশিদুল হাসান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে তাদের সন্তান ও স্বজনরা এ পদক গ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শহীদ মোফাজ্জল হায়দারের ছেলে তানভীর হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘শহীদ পরিবারের সন্তানদের অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বড় হয়েছেন। এই ক্যাম্পাসকে এখনও নিজেদের আঙিনা বলে মনে করেন। কখনও কোনো বিকেলে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে তাদের মনে হয়- এই তো খেলাধুলা শেষ করেই বাসায় ফিরবেন তারা।’
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা স্বাধীনতার এত বছর পর তাদের পিতাকে সম্মাননা জানানোর জন্য ধন্যবাদ জানান। শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনির তন্ময় বলেন, নতুন প্রজন্ম এই শহীদ শিক্ষকদের অবদানকে ভুলে যাচ্ছে। তাই তাদের নিয়ে আরও প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের অবদানকে পৌঁছে দিতে হবে। শহীদ এম এ রাশিদুল হাসানের সন্তানের বলেন, এসব শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বিষয়ে এখনও কোনো সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয়নি। এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, এদেশের সূর্য সন্তানদের হত্যা করে পাকিস্তানিরা এ জাতিকে পিছিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ বাংলাদেশ সব খাতে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। এটাই এ জাতির বড় অর্জন। তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। তবে শুধু সম্পদে উন্নত হলে হবে না; মেধা, মনন ও সংস্কৃতিতেও উন্নত হতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সরকারি গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
সভাপতির বক্তৃতায় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, আজকের দিন একই সঙ্গে বেদনার ও আনন্দের। দীর্ঘদিন পরে হলেও জাতির এই সূর্য সন্তানদের স্মরণ করতে পেরেছি। তিনি বলেন, এবার সাত বুদ্ধিজীবীকে সম্মাননা দেওয়া হলো, আগামীতে বাকি শহীদ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও সম্মাননা দেওয়া হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কর্ম ও সাহিত্য সংরক্ষণ ও প্রচারে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ভূমিকা রাখবে বলে জানান তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সরকারি গেজেটে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন এফবিসিসিআইর সাবেক এই সভাপতি।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী নিজের স্মৃতিচারণ করে বলেন, শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও শহীদ মনিরউজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভবনে বাস করতেন, তিনিও সেই ভবনে থেকেছেন। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই জাতি গঠনে নানাভাবে অবদান রেখেছে। তবে এর সবচেয়ে বড় অবদান হলো মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষকরা মুক্তির সংগ্রামে জীবন দিয়েছেন।
সাবেক উপাচার্য ড. এসএমএ ফায়েজ বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা সবাই ছিলেন মুক্তমনের মানুষ। তারা প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। তাদের আদর্শকে নতুনদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামান বলেন, শহীদ শিক্ষকরা ছিলেন জাতির দিশারি। তারা নিয়মিত ক্লাসের মধ্যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভুলত্রুটি তুলে ধরতেন। ছাত্রদের স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য গড়ে তুলতেন। তাই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের বেছে বেছে হত্যা করেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা তপন চৌধুরী বলেন, এই শহীদ বুদ্ধিজীবীরা শুধু শিক্ষকই ছিলেন না, ছিলেন জাতির পথপ্রদর্শক। তাদের আদর্শ, মূল্যবোধকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. নাসরিন আহমদ, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট মোল্লা মো. আবু কাওছার এবং অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রঞ্জন কর্মকার।