স্মরণে শপথে ১৫ আগস্ট
বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাকরা জড়িত ছিল। বঙ্গবন্ধু মানুষকে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবেননি। ফলে খুব সহজে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের এসব মদদদাতার বিচার করতে হবে। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পর যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জননেত্রী শেখ হাসিনা করতে পারেন, তাহলে তাদের বিচারও অসম্ভব কিছু নয়। এর জন্য যে তদন্ত কমিশনের কথা বলা হচ্ছে, সেটি করতে হবে।
গতকাল শনিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের অ্যালামনাই ফ্লোরে ‘স্মরণে শপথে ১৫ আগস্ট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ. কে. আজাদের সভাপতিত্বে এবং মহাসচিব রঞ্জন কর্মকারের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ফরাসউদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত অন্যতম সহযোগী হাজি গোলাম মোর্শেদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ, অ্যালামনাইর সিনিয়র সহসভাপতি মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাওছার, সহসভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ প্রমুখ।
সভায় আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, বঙ্গবন্ধু কেবল একটি নাম নয়, এটি একটি ইতিহাস ও সংগ্রামের নাম। আর তার জীবনাদর্শকে আমরা একটি দর্শন হিসেবে বিবেচনা করি। জাতিসংঘের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুইভাগে বিভক্ত- একদল শোষক, আরেক দল শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন, তার নেতৃত্ব শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্ব পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট জাতির জন্য একটি কলঙ্কিত দিন। এদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত ছিল না। একটি জাতিকে পেছনের দিকে ঠেলে দিতে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা তৎপর হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে জিয়া-মোশতাক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। তার প্রমাণ তাদের পরবর্তী কর্মকাণ্ড এবং আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশি ও বিদেশি মিডিয়ায় সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পুনর্বাসিত করেছিল জিয়াউর রহমান। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করে রেখেছিল।
মন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর রক্তকে কুচক্রীরা ভয় পায়। সেই রক্তকে শেষ করে দেওয়ার জন্য জিয়া পরিবার ও কুচক্রীরা আগেও তৎপর ছিল, এখনও আছে। তাদের রুখে দিয়ে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে নেই। তবে তার জীবনাদর্শ আমাদের মধ্যে আছে, সেগুলো আঁকড়ে ধরতে হবে। আমরা বঙ্গবন্ধুর ঋণ তখনই শোধ করতে পারব, যখন আমরা তার আদর্শকে ধরে স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ করতে পারব। এ দেশের মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে পারব।
ফরাসউদ্দিন বলেন, যেসব মিলিটারি ও সিভিল আমলা বঙ্গবন্ধুর লাশ ধানমণ্ডি ৩২-এর সিঁড়িতে রেখে মোশতাকের অভিষেক অনুষ্ঠান পালন করেছিল, তারা আজও বিদ্যমান। তাদের ব্যাপারে তৎপর থাকা প্রয়োজন।
অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, বঙ্গবন্ধু মানুষকে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবেননি। ফলে মোশতাকের মতো চাটুকাররা এত সহজে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। সপরিবারে তাকে হত্যার মাধ্যমে ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ ও বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে দেবে। কিন্তু যতই দিন গড়াচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে নতুন রূপে আমরা আবিস্কার করছি। কাজেই তাদের আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, আমার সৌভাগ্য যে, আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছি। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল, তারা আমাকেও বিভিন্নভাবে নির্যাতন করেছিল। ১৯৬৭ সালে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রভাবিত হয়ে তাকে উৎসর্গ করে কবিতা লিখেছিলাম।
হাজি গোলাম মোর্শেদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাটানো বিভিন্ন সময়ের স্মৃতিচারণ করেন। এর মধ্যে ১৫ আগস্ট, ৭ মার্চের ভাষণ ও ২৫ মার্চের কালরাতের ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
সভাপতির বক্তব্যে এ. কে. আজাদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সারাদেশে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। তেমনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনও বেশ কিছু কর্মসূচি নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের যুবসমাজ নিয়ে ভাবতেন। কারণ, এই যুবসমাজই রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি। এই যুবসমাজকে যদি আমরা কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে দেশ সমৃদ্ধিশালী হবে না; দেশ আত্মনির্ভরশীল হবে না। তাই সেই যুবসমাজের জন্য আমরা কতটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি, বেকারত্ব কতটা কমাতে পারি- সে ব্যাপারে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই কর্মসূচি নেবে।
তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারে আমাদের জোর দিতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় জোর দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষিত কোনো বেকার যেন না থাকে, সে ব্যাপারেও আমরা কর্মসূচি হাতে নেব। ৮ শতাংশেরও বেশি জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার আমাদের বিরাট সাফল্য। এ দেশের অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করার ব্যাপারেও আমরা কাজ করব। শিশু স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও সারাদেশে আমাদের বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে। এরই মধ্যে তাদের মাধ্যমে মাদক ও বাল্যবিয়ে বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান পরিচালিত হয়েছে। আমরা সেসব শিক্ষার্থীকে সেভাবেই প্রশিক্ষিত করছি। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তাদের কাজে লাগাব।
এ. কে. আজাদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্র এ মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেবে। তাই বঙ্গবন্ধু সবার প্রথমে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে জোর দিয়েছিলেন। এর আগে মাত্র সাত কোটি মানুষের জন্য খাদ্যের নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু আজ প্রায় ১৮ কোটি মানুষের এই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এটি তখনকার সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনারই ফসল। তার সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে সেই ভাবনা আজ বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। আমরা এখন বিভিন্ন দেশে খাদ্য রফতানি করছি। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।