৭১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন

মুখ ভার করেছিল গতকাল আশ্বিনের বিকেলটা। আকাশে ঘনকালো মেঘের আনাগোনা, আষাঢ়ের আবহ। অবশেষে শুরু হলো বৃষ্টি, পুরোপুরি মুষলধারে। সেই বর্ষণ উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) উপস্থিত হয়েছিলেন প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা। ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল গত ২৪ সেপ্টেম্বর। গতকাল শনিবার সেটি উদযাপন করা হয় সাড়ম্বরে। এ উপলক্ষে টিএসসির আঙিনা পরিণত হয়েছিল অ্যালামনাইদের সুবিশাল মিলন মেলায়। বিভিন্ন ব্যাচের ও বিভাগের প্রাক্তনদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছিল টিএসসির সবুজ চত্বর।

অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে চলেছে পরস্পরের সঙ্গে কুশল বিনিময়, আড্ডা আর খুনসুটি। ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছেন সবাই। উদ্বোধনী পর্বের পর ছিল আলোচনা অনুষ্ঠান ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পর্বও।
টিএসসির সবুজ চত্বরে শামিয়ানা টানিয়ে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী পর্বের। শুরুতেই ছিল জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা যখন দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীতের কথা-সুরে নিজেদের গলা মেলাচ্ছিলেন, আকাশ ভেঙে নামা প্রবল বৃষ্টির মূর্ছনা তার সঙ্গে মিশে সৃষ্টি করেছিল অপূর্ব দ্যোতনা। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটির সঙ্গে মনোমুগ্ধকর নৃত্য পরিবেশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের ছাত্রীরা।

অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। তার সঙ্গে উদ্বোধনী পর্বে আরও অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি ও খনিজসম্পদক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম, বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, অ্যালামনাই শেখ কবির হোসেন, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, বর্তমান সভাপতি এ. কে. আজাদ ও মহাসচিব রঞ্জন কর্মকার।
উদ্বোধনী বক্তব্যে অ্যালামনাইয়ের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানান উপাচার্য। তিনি বলেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কমিউনিটির সঙ্গে মিলে এর শিক্ষা, পরিবেশ ও অবকাঠামোর উন্নয়নে কাজ করছে, আশা করি ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত রাখবেন তারা।

জাতীয় পতাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যালামনাইয়ের পতাকা উড়িয়ে এর উদ্বোধনের সময় বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাইসহ বিভিন্ন হল ও বিভাগীয় অ্যালামনাইয়ের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় অতিথিরা কেক কাটেন। এদিন ৭৩তম জন্মদিন থাকায় কেকটি উৎসর্গ করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

উদ্বোধনী পর্বের পরে টিএসসি মিলনায়তনে শুরু হয় ‘আলমা মেটারের প্রতি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের দায়বদ্ধতা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ. কে. আজাদের সভাপতিত্বে ও মহাসচিব রঞ্জন কর্মকারের পরিচালনায় আলোচনা সভায় অ্যাসোসিয়েশনকে নানা পরামর্শ দেন অ্যালামনাইরা। তারা বিশ্বের সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন। আগামী ১০ বছরের মধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে সেরা ১০০তম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দেখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, এজন্য অ্যালামনাই হিসেবে তারা তাদের পক্ষ থেকে করণীয় যা কিছু আছে, তা করতে প্রস্তুত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তারা এজন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন। এসময় শিক্ষকদের সঠিকভাবে ক্লাস নেওয়া, যোগ্য প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, শিক্ষকদের গবেষণাসহ আরও নানা বিষয় আলোচনায় উঠে আসে। প্রাক্তনরা বলেন, শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বিশ্বের সেরা এক হাজারে নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। তবে এ হতাশাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সেরা একশতে নিয়ে আসতে হবে। এরজন্য শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে। গবেষণার প্রতি জোর দিতে হবে। এরসঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে।

অ্যালামনাইয়ের সভাপতি এ. কে. আজাদের সভাপতিত্বে ও মহাসচিব রঞ্জন কর্মকারের সঞ্চালনায় সভায় বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, এনবিআরের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, অ্যালামনাইয়ের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, সাবেক সভাপতি ও মহাসচিব রকিবউদ্দীন আহমেদ, অ্যালামনাইয়ের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু সালেহ, পুলিশের সাবেক আইজি এনামুল হক, ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক হোসেন, সাবেক সচিব সোহেল চৌধুরী, অ্যালামনাইয়ের জ্যেষ্ঠ সদস্য সেলিনা খালেক, শিল্পী ফকির আলমগীর, অ্যাডভোকেট এম কে রহমান প্রমুখ।

আলোচনায় ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেরা এক হাজারে স্থান করতে পারেনি। এটি দুঃখজনক। তবে আমরা এর জন্য এখনও কিছু করতে পারি। প্রথমে শিক্ষার মান ও গবেষণার দিকে জোর দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ থেকে ৫০ ভাগ রেটিং আসে শিক্ষকের যোগ্যতা, গবেষণা এবং সাইটেশনের ওপর। প্রাথমিক পদক্ষেপের জন্য আমাদের ওয়েট লিস্টে যেতে হবে। এর জন্য প্রকাশনা দরকার। অ্যালামনাইয়ের পক্ষ থেকে একটি ‘টাস্কফোর্স’ গঠন করা যেতে পারে। আগামী ১০ বছরে কীভাবে সেরা একশতে আসতে পারি, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে মিলে কাজ করা যেতে পারে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি সাংস্কৃতিক বলয়ের মধ্যে অবস্থান করছে। সেখানে একটি গ্রন্থ প্রাঙ্গণ থাকা দরকার। সবাই যেন এখানে এসে বই পায়। এটি অত্যাবশ্যকীয়। কাঁটাবন এলাকায় একটি বইয়ের প্রাঙ্গণ গড়ে তোলা যেতে পারে। আবশ্যক আরেকটি বিষয় হলো মুক্তি সংগ্রামের সংগ্রহশালা। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সকল উপাদান এখানে সংরক্ষিত থাকবে। যার যখন প্রয়োজন সেগুলো দেখবে এবং প্রয়োজনে গবেষণা করবে। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা আলমা মেটার বলছি। একে পালিত মা হিসেবে দেখছি আমরা। মায়ের মলিন চেহারা দেখলে যেমন আমরা নয়ন জলে ভাসি, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিন চেহারা আমাদের বিষন্নতায় ডোবায়। এই বিষন্নতা ঘোচাতে হবে। এখানে জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।

মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেরা এক হাজারেও নেই, এটি হতশাজনক। কাজেই শিক্ষার মান বৃদ্ধি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষক নিয়োগের সময় ভালো মানের শিক্ষক বাছাই করতে হবে। এক্ষেত্রে ছাত্রদের পড়ানোয় দক্ষ, মেধাবী এবং শিক্ষকতার প্রতি বিশ্বস্তদেরই নির্বাচন করতে হবে। এ কাজে অ্যালামনাই নজরদারি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সহায়তা করতে পারে। অ্যালামনাই এ ব্যাপারে পরামর্শও দিতে পারে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সময়ও ছাত্ররাজনীতি ছিল। কিন্তু সেটি এখনকার ছাত্ররাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন ছাত্রজীবন শেষ করার আগেই তারা গাড়ি-বাড়ির কথা ভাবে। এভাবে ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করে ফেলা হয়েছে। এর থেকে উত্তরণ দরকার।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘অ্যালামনাইয়ের মনোভঙ্গি ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই। অ্যালামনাইয়ের সদস্যদের প্রস্তাবনা ও পরামর্শগুলো পয়েন্ট আকারে লিপিবদ্ধ করেছি। সেগুলো মাননীয় উপাচার্যের কাছে উপস্থাপন করব।’সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়তা করেছে। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে হাত দিয়েছি। প্রতি বছর ১২শ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিচ্ছি। এই খাতে প্রতি বছর ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। আমরা টিএসসির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে হাত দিয়েছি। টয়লেটগুলোকে আধুনিক মানসম্পন্ন করে সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনার অভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পরই আগের অবস্থানের মতো হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি চায় তাহলে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আমরা নিতে পারি। তিনি বলেন, আমাদের লাইব্রেরির অবস্থা খুবই খারাপ। শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়লেও লাইব্রেরির সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়নি। এ বিষয়ে অ্যালামনাই কাজ করতে চায়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নেও আমরা কাজ করতে পারি।

অনুষ্ঠানে মহাসচিব রঞ্জন কর্মকার বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব করেন।