হীরক জয়ন্তী মহোৎসব-২০১২ পালন
আনন্দ আর উল্লাসের মধ্যে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের “হীরক জয়ন্তী মহোৎসব” পালিত হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে ছাত্র-শিক্ষক ও গবেষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কাজ করার আহ্বান জানান অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের জীবন সদস্য ও রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। প্রধান অতিথির বক্তব্যে বারবার রাষ্ট্রপতি ফিরে যান তার পুরনো দিনের স্মৃতিতে।তিনি বলেন, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বহু জ্ঞানী-গুণী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অবদান রেখে যাচ্ছেন।শিক্ষা প্রসারে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঐতিহ্য তা সমুন্নত রাখতে হবে। এজন্য ছাত্র, শিক্ষক, গবেষকসহ সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে।শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়া ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে অ্যালামনাইদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে হবে।
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ, বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. অশোক মিত্র,বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. আবদুল মঈন খান, অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান প্রমুখ।
অনুষ্ঠান শুরুর আগে কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের গানের ‘মনে পড়ে যায়/পুরনো দিনের কথা’ গানটি থিম সঙ হিসেবে বেজে ওঠে। নৃত্যের তালে উচ্ছ্বসিত পরিবেশ উপহার দেন এক তরুণী। এরপর গুটিকয়েক পায়রা ও বেলুন উড়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যালামনাইয়ের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও বয়োজ্যেষ্ঠ অ্যালামনাই মিসবাউল বার চৌধুরী। মেজবাউল বার চৌধুরী ১৯৪০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেন । স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার কেবলই মনে হচ্ছে আমি আমার ছাত্র জীবনে ফিরে এলাম। সাবেক এ শিক্ষার্থী বলেন,আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন মাত্র ২টি হল ছিল। এখন অনেক হল হয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আসলে কি প্রকৃত শিক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে কি না সেটা আজকের শিক্ষার্থীরা বলতে পারবেন। তিনি বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমার অহঙ্কার হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা ভাষা আন্দোলনের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য জীবন দিয়েছেন। পৃথিবীর আর কোথাও এমন বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তিনি বলেন, এ বয়সেও আমার মন চায় আনন্দে ভেসে যেতে। কিন্তু আমার দেহ নারাজ। সাবেক এই শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের সময় ক্যাম্পাস খুব শান্ত ছিল। ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে সহমর্মিতা ছিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা পাল্টে গেছে।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের মহাসচিব রকীবউদ্দিন আহমেদ, সঞ্চালনের একপর্যায়ে তিনি অ্যালামনাইদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা যারা ছাত্রজীবনে খুব ভালো বন্ধু ছিলেন এবং যাদের সঙ্গে “এটা ওটা” সম্পর্ক ছিল তারা সাবধান থাকবেন। কারণ বিভিন্ন চ্যানেলে এই অনুষ্ঠান সরাসরি দেখানো হচ্ছে, তা না হলে আপনাদের পারিবারিক জীবনে সমস্যা হতে পারে। তার এই বক্তব্য সবার মাঝে এক আনন্দের ঢেউ সৃষ্টি করে।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বহতা নদী। এখানে সবকিছুই পাওয়া যায়। আজকের অনুষ্ঠান সবকিছুকে পাওয়ার মতোই একটা দিন। তিনি বলেন, প্রাক্তন ছাত্ররা ছাত্রজীবনে অনেক কিছু নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখন শুধু দেয়ার পালা।
প্রাক্তন আরেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, কোনো কিছুই প্রাক্তন নয়। তাই তিনিও প্রাক্তন হননি। বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়ার এখনো অনেক কিছু বাকি রয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধু সরকারের ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না, নিজস্ব অর্থায়ন থেকেও কিছু করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে প্রাক্তন ছাত্র ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. এম ওসমান ফারুক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্বের অবস্থানে নেই। ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি আগের অবস্থান থেকে দূরে সরে এসেছে।
ড. অশোক মিত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। তার ৫ পুরুষ ঢাকায় বাস করেছে।কিন্তু হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কারণে অশোক মিত্র মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যান ভারতে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সার্টিফিকেটটি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেননি। মাস্টার্সে ভর্তি হলেও তৎকালীন সরকারের হুলিয়ার কারণে তা শেষ করে যেতে পারেননি। অশোক মিত্র পশ্চিম বাংলার প্রয়াত জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী ছিলেন।গতকাল তার হাতে ৬৪ বছর পর অনার্সের সার্টিফিকেট তুলে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে ড. অশোক মিত্র বলেন, আমৃত্যু আমার বুকের ওপর এ সার্টিফিকেট ধরে রাখবো।তিনি বলেন- আমি যা হতে পেরেছি, যা হয়েছি তার সমস্তের মূলে এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাবির শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও বন্ধু-বান্ধবদের কারণেই আমি এতদূর এগিয়ে যেতে পেরেছি। তিনি বলেন, জীবনে যত ভুলই করি কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিমকহারামি করতে পারবো না। সাবধান থাকবেন!
অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান। নামকরা অর্থনীতিবিদ। দেশে-বিদেশে তার রয়েছে সুনাম।ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করে মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু ক্লাসের ছাত্ররা ছিলেন তার চেয়ে বয়সে বড়। অতীত দিনের স্মৃতি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম তার ছাত্র ছিলেন। বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের অনারারি সদস্য। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, তখন ১২ ঘণ্টার ক্লাস নিতাম। ক্লাসে ৬ ঘণ্টা এবং ৬ ঘণ্টা টিউটোরিয়াল ক্লাস নিতে হতো। সিরিয়াসলি ক্লাস নিতাম। আমার ক্লাসের ছাত্ররা আজ দেশের নামকরা অর্থনীতিবিদ।
একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সুখ-দুঃখের কথা নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমান, কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী, ১৯৪০ সালের স্নাতক ও সাবেক ডিপিআই এমবি চৌধুরী, ১৯৪৪ সালের স্নাতক ও সাবেক সচিব এ কে এম জাকারিয়া,১৯৪৫ সালের স্নাতক ও যুক্তরাজ্যের স্যানডিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আফিয়া দিল, ১৯৪৮ সালের স্নাতক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এ কে এন আহমেদ প্রমুখ।
প্রায় ১০ হাজার অ্যালামনাইর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ ছাড়াও আড্ডা, বেশ কয়েক পর্বের নাস্তা ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার এবং বিকালের নাস্তার জন্য অ্যালামনাইদের দাঁড়াতে হয়েছে দীর্ঘ লাইনে। কিন্তু তারপরও কার কাছে কোন বিরক্তিবোধ নেই। বিশৃঙ্খল পরিবেশেরও সৃষ্টি হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গেছেন অনেক দিন। বয়সও বার্ধক্যের কোটায়। সব ভুলে স্মৃতি রোমন্থনে পুরো একটি দিন প্রিয় ক্যাম্পাসে আনন্দের ভেলায় ভাসলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুড়ো শিক্ষার্থীরা। সহপাঠীদের সঙ্গে মাতলেন গল্প, আড্ডা আর গানে। প্রাণের বন্ধনে একে অন্যের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে প্রত্যেকেই যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য ফিরে গিয়েছিলেন সেই সব হারানো দিনে, নিজেদের ভরা তারুণ্যে।হাতড়ে ফিরেছেন ক্যাম্পাস জীবনের সেই উচ্ছ্বল, বাধাহীন, তারুণ্য ও যৌবনের ছোটগল্পগুলোকে। নাচে গানে তারা অনুষ্ঠানকে মাতিয়ে রেখেছেন সকাল থেকে রাত অবধি। এ যেন বার্ধক্য থেকে তারুণ্যে ফেরার অকৃত্রিম চেষ্টা।